বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে? 

তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের ধরণে এসেছে আমূল পরিবর্তন। গতানুগতিক ব্যবসাগুলোর পাশাপাশি এখন সফলভাবে জায়গা করে নিচ্ছে একের পর এক ই-কমার্স বিজনেস। বিশেষ করে করোনা মহামারীর সময় থেকে ই-কমার্স হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক বিজনেস মডেলগুলোর একটি। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশেও বাড়ছে সাকসেসফুল ই-কমার্স বিজনেসের সংখ্যা। এই ই-কমার্স সেক্টর সত্যিকার অর্থে কতটুকু সম্ভাবনাময় সে বিষয়ে অনেকেই জানতে চান। তাদের জন্য আজকের লেখায় থাকছে বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। 

ই-কমার্স ব্যবসা কাকে বলে? 

চলুন লেখার শুরুতে ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক। ই-কমার্স বলতে অনলাইনে অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজের ব্যবসার পণ্য সেল করাকে বোঝানো হয়। ই-কমার্স প্রক্রিয়া এবং প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন এখানে

সাধারণত ই-কমার্স ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে এই ব্যবসাটি পরিচালনা করা হয়। ই-কমার্সের

 

 ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৮২ সালে দ্যা বোস্টন কম্পিউটার এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ই-কমার্স বিজনেসের পথচলা শুরু হয়। সেই থেকে জনপ্রিয়তা পেতে পেতে ই-কমার্স এখন পরিণত হয়েছে একটি মাল্টি বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রিতে। 

বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স ব্যবসার এত জনপ্রিয়তার কারণ হলো এটি এমন একটি বিজনেস মডেল যেটি পরিচালনা করার জন্য আপনাকে বাড়তি দোকান ভাড়া দিতে হবেনা। পাশাপাশি যেহেতু এটি অনলাইনে করা হয় এবং ইন্টারনেট ইউজারদের সংখ্যা অনেক, তাই এখানে টার্গেটেড কাস্টমারদের রিচ করাও তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ। এসব কারণে অনেকেই এখন ই-কমার্স বিজনেস শুরু করছেন এবং সাকসেসফুলও হচ্ছেন। 

বাংলাদেশে ই-কমার্সের সূচনা কেমন ছিলো?

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানার আগে চলুন ই-কমার্সের শুরুর দিক সম্পর্কে একটু জেনে আসা যাক। বেশিরভাগের মতে, মুনশিজি ছিলো বাংলাদেশের একদম প্রথম ই-কমার্স সাইট। ১৯৯৯ সালে এটির যাত্রা শুরু হয়। এই ব্যবসার মূল পণ্য ছিলো সিল্ক, হ্যান্ডিক্রাফটস, চা, পাট ও চামড়ার তৈরি পণ্য ইত্যাদি। এই ই-কমার্স সাইটটি তৈরি করা হয়েছিলো পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানি করার উদ্দেশ্যে। তারপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে চালু করা হয় ক্লিক বিডি ডট কম ও সেলবাজার নামে আরো দু’টো ই-কমার্স সাইট। 

এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো, বাংলাদেশে জোরেশোরে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সাল থেকে। ২০১১ তে এখনি ডট কম নামের ই-কমার্স সাইটটি লঞ্চ করা হয়। পরে যদিও এটির নাম বদলে বাগডুম ডট কম রাখা হয়। ২০১১ তেই আজকের ডিল নামে আরো একটি ই-কমার্স বিজনেস লঞ্চ করা হয়। তারপর ২০১২ তে যখন রকমারি, বিক্রয় ডট কম এবং ২০১৩ সালে চাল ডাল ডট কম ও দারাজের পথচলা শুরু হয়, তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে ই-কমার্স বিজনেসের সংখ্যা। বর্তমান সময়ের আরো কিছু সফল কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হলো অথবা, সাজগোজ, প্রিয়শপ, সিন্দাবাদ ইত্যাদি। 

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার বর্তমান অবস্থা  

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর ২০২১ সালে প্রকাশিত হওয়া একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশের ই-কমার্স বিজনেসগুলো নিজেদের প্রচারণা ব্যাপকভাবে বাড়াতে শুরু করে এবং ২০২০ থেকে তারা পুরোদস্তুর ব্যবসা শুরু করে। 

E-commerce business prospect in Bangladesh

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি ই-কমার্স বিজনেস রয়েছে, যেগুলোর ১ শতাংশ বড় পরিসরে, ৪ শতাংশ মাঝারি পরিসরে এবং বাকি ৯৫ শতাংশ ছোট পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে। ই-কমার্সের পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি এফ কমার্স পেইজ সক্রিয়ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। 

আমি জানি, আপনারা হয়তো এখন জানতে চাইবেন যে দেশে ই-কমার্স ব্যবসা সম্পর্কিত কোনো লিখিত নীতিমালা রয়েছে কিনা। এ প্রশ্নের উত্তর হলো হ্যাঁ, রয়েছে! দেশে প্রতিটি ই-কমার্স ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে এবং একইসাথে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল কমার্স পলিসি প্রণয়ন করেছে, যেখানে ই-কমার্স ব্যবসার বিভিন্ন সমস্যা যেমন: হ্যাকিং, কপিরাইট কিংবা প্রোডাক্টের মূল্যজনিত সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। একইসাথে ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট গেটাওয়ে এসক্রো সার্ভিস চালু করেছে, যা ই-কমার্সকে করে তুলেছে আরো নিরাপদ।

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা 

ই-কমার্সের দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭ তম

। একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা এই ব্যবসা যে দারুণ সম্ভাবনাময় তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশই নেই। 

ইউএনবি এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের ই-কমার্স মার্কেট সাইজ ছিলো প্রায় ৫৬৮.৭০ বিলিয়ন টাকার, যা ২০২২ এ প্রায় ৬৬০ বিলিয়ন টাকায় পৌঁছোবে বলে ধারণা করা হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, আশা করা হচ্ছে ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের ই-কমার্স মার্কেট সাইজ প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছোবে।  এটুকু জানার পর এখন আপনারা ধারণা করতে পারছেন আমাদের দেশের ই-কমার্স সেক্টরের ভবিষ্যৎ কতটুকু সম্ভাবনাময় হতে পারে।

E-commerce Bangladesh Market size forecast
বাংলাদেশের ই-কমার্স মার্কেট গতিপ্রকৃতি

যদি এবার আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো ই-কমার্স সেক্টরে ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণও আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। যেমন: দ্যা নিউজ এইজ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্সের জন্য ইনভেস্টমেন্ট ছিলো প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে ১০ মিলিয়ন ডলার ছিলো ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট। 

এরপর যত সময় গেছে, এই সেক্টরে ইনভেস্টমেন্ট বেড়েছে। যেমন: প্রথম আলোর ভাষ্যমতে, ২০১৮ সালে ই-কমার্স জায়েন্ট আলিবাবা দারাজকে অধিগ্রহণ করার পর বাংলাদেশে ১২৫ মিলিয়ন ডলার ফরেন ইনভেস্টমেন্ট এসেছিলো (২০২০ এর হিসাব অনুযায়ী)। তাই বলা যেতে পারে, ইনভেস্টমেন্ট বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে ই-কমার্স হয়ে উঠছে শক্তিশালী ও লাভজনক একটি ক্ষেত্র। 

বাংলাদেশের ইন্টারনেট এবং ই-কমার্স গ্রাহক সংখ্যা

বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ আরো উজ্জ্বল হওয়ার আরেকটি কারণ হলো আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এমন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (BTRC) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিলো ৬৬.৬ মিলিয়ন, যা ২০১৯ এ দাঁড়ায় ৯৬.১৯ মিলিয়নে। 

বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ ও টেলিনর ধারণা করছে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশের ৩২ শতাংশ পরিবারে অন্তত একটি হলেও ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে। আমরা সবাই জানি ই-কমার্স ব্যবসার মূল ভিত্তিই ইন্টারনেট, তাই দেশে ইন্টারনেট ইউজারদের সংখ্যা যত বাড়ছে, ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ তত বেশি উজ্জ্বল হচ্ছে। 

ই-কমার্স গ্রাহক বৃদ্ধির কারন

তারপর আমরা যদি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, এখন দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিজেদের অফিস কিংবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। এরপর একটু সময় বের করে যে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করবেন, সে সময় বা এনার্জি তাদের কাছে থাকেনা। তার ওপর বাইরে বেরোলে ট্রাফিক জ্যাম তো আছেই। এসব কারণে মানুষ এখন বাড়িতে বসে ই-কমার্স ওয়েবসাইট থেকে কেনাকাটা করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। যেহেতু এই ওয়েবসাইটগুলোতে পেমেন্ট গেটাওয়ে সংযুক্ত করা থাকে, তাই তারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পেমেন্টও করতে পারছেন। 

অর্থাৎ ই-কমার্স মানুষের কেনাকাটার কাজটিকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ প্রতিনিয়তই ই-কমার্স সাইট থেকে কেনাকাটা করেন এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং নিশ্চিতভাবেই এ সংখ্যা সামনে আরো বাড়বে। 

পরিশেষে

বর্তমানে বাংলাদেশে যে কয়েকটি সম্ভাবনাময় ব্যবসার খাত রয়েছে ই-কমার্স সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের জিডিপির হার বাড়িয়ে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন আনতে ই-কমার্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদি ই-কমার্স সেক্টরে থাকা বর্তমান সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করা সম্ভব হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে এটি হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অন্যতম সফল ও শক্তিশালী খাত।

ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করুন
দেশী কমার্স দিয়ে সহজে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করুন।
এই পোস্টটি শেয়ার করতে ক্লিক করুনঃ

Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments

ইকমার্স সম্পর্কিত বিভিন্ন টিপস এবং নিউজ পেতে আমাদের সাথে থাকুন

* indicates required